Monday, September 25, 2017

আজ ২৫ সেপ্টেম্বর। ১৮৯৩ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন সুইডিশ গণিত ও পরিসংখ্যানবিদ হ্যারাল্ড ক্র্যামার। গাণিতিক পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনাভিত্তিক সংখ্যা তত্ত্বের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ গণিতবিদ জন কিংম্যান এর মতে,
 হ্যারাল্ড ক্র্যামার হলেন পরিসংখ্যানিক তত্ত্বের অন্যতম দৈত্য। 
হ্যারাল্ড ক্র্যামার 

জন্ম সুইডেনের স্টোকহোমে। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এই শহরের আশেপাশেই। ১৯১২ সালে ভর্তি হন স্টোকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়েন গণিত ও রসায়ন নিয়ে। ল্যাবের অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে টেনে আনে গণিতের দিকে। শেষ পর্যন্ত একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মারসেল রিয়েজ এর অধীনে ডক্টরেট শুরু। এ সময় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জি এইচ হার্ডির দ্বারাও। এই সেই হার্ডি, যিনি বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ রামানুজানের প্রতিভা প্রচার ও প্রকাশেও ভূমিকা রেখেছিলেন। যাই হোক, এ দুজনের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯১৭ সালে ক্র্যামার ডিরিকলেট ধারার ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

পিএইচডি লাভ করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে থাকেন ১৯২৯ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের শুরুর দিকে তিনি অ্যানালিটিক নাম্বার থিওরি (সংখ্যা তত্ত্ব) নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। এছাড়াও তিনি মৌলিক সংখ্যা (Prime number) ও যমজ মৌলিক সংখ্যার বিন্যাস নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৩৬ সালে এ বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেপারখানা প্রকাশিত হয়।$^{[1]}$ এখানে তিনি সংখ্যা তত্ত্বে সম্ভাবনার (Probability) ভূমিকার বিবরণ দেন। এছাড়াও দেন প্রাইম গ্যাপ বা মৌলিক সংখ্যার ব্যবধানের (Prime gap) একটি হিসাব। এটি পরে ক্র্যামার কনজেকচার নামে পরিচিত হয়।

সম্ভাবনা তত্ত্বের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন ১৯২০ এর দশকে। সে সময় এই ক্ষেত্রটিকে গণিতের শাখা মনে করা হত না। ক্র্যামার এটা মানতে পারলেন না। ১৯২৬ সালের এক পেপারে তিনি লেখেন,
সম্ভাবনার ধারণার ভিত্তি হওয়া উচিৎ বিশুদ্ধ গাণিতিক সংজ্ঞা, যা থেকে গাণিতিক অপারেশনের মাধ্যমেই সম্ভাবনার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও চিরায়ত উপপাদ্যগুলো বের করা হবে। 
১৯৩০ এর দশকে কলমোগোরভ, লেভি ও খিনচিন এর মতো গণিতবিদরা সম্ভবানার গাণিতিক রূপায়নের জন্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ক্র্যামার তাঁদের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হন। শুধু তাই নয়, নিজেও অবদানও রাখা শুরু করেন।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ম্যাথেম্যাটিক্যাল মেথডস অব স্ট্যাটিসটিক্স। এ বই থেকেই প্রমাণ হয়, পরিসংখ্যান চর্চা নিতান্তই একটি গাণিতিক বিশ্লেষণ।

ক্র্যামারের বিখ্যাত বই Mathematical Methods of Statistics

১৯২৯ সালে ক্র্যামার স্টোকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রতিষ্ঠিত Actuarial Mathematics and Mathematical Statistics বিভাগের চেয়ারম্যান হন। এ পদে থাকেন ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৫০ সালে অ্যামেরিকান স্ট্যাসটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এর ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সাল থেকে তিনি স্টোকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও কাজ করতে থাকেন। ১৯৫৮ সালে সুইডেনের সমগ্র ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের আচার্য মনোনীত হন। অবশ্য অবসর নেন ১৯৬১ সালেই।

জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কাটান বিমা বিজ্ঞান (Actuarial science) ও বিমা গণিত নিয়ে কাজ করে করে।

১৯৬১ সালে অবসর গ্রহণের পরে গবেষণার দিকে আরও ভালোভাবে মনোনিবেশ করেন। এভাবেই পার করেন জীবনের শেষ ২০ বছর। এ সময় ইউরোপ ও অ্যামেরিকা জুড়ে ব্যাপক সফর করেন।

১৯৭২ সালে হেরিওট-ওয়াট ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে নিজ দেশে পরলোকগমন করেন পরিসংখ্যানের অন্যতম এই 'দৈত্য'। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।

সূত্রঃ
১। মৌলিক সংখ্যা নিয়ে পেপার
২। উইকিপিডিয়াঃ হ্যারাল্ড ক্র্যামার
Category: articles

Friday, September 22, 2017

আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। সংখ্যা পদ্ধতির যদিও অনেকগুলো নিয়ম আছে তবু আমরা সাধারণত ব্যবহার করি দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি (Decimal Number System)। এ ধরনের পদ্ধতিতে ০ থেকে ৯ পর্যন্ত মোট দশটি সংখ্যা থাকে। হায়! হায়! প্রশ্নই করতে ভুলে গেলাম। প্রশ্ন হল, দৈব পদ্ধতিতে (at random) যে কোনো অঙ্কের (digit) যে কোনো একটি সংখ্যা নিলে সেই সংখ্যাটি ১ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনা (Probability) কত? অথবা ৩ দিয়ে বা ৬ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনাই বা কত?

নিশ্চয় ভাবছেন, এ তো ভারি সোজা কাজ। দশমিক পদ্ধতিতে অঙ্ক আছে ১০ টি। এর মধ্যে ০ দিয়েতো আর কোনো সংখ্যা শুরু হতে পারে না। তাই, সব সংখ্যাই ১ থেকে ৯ -এই অঙ্কগুলোর কোনো একটি দিয়েই শুরু হবে। অতএব, কোনো একটি সংখ্যা ১ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনা ৯ এর মধ্যে ১। সম্ভাবনার ভাষায় $\frac{১}{৯}$ বা প্রায় ১১ শতাংশ। একই সম্ভাবনা প্রযোজ্য হওয়া উচিত ৩, ৬ বা অন্য যে কোন অঙ্কের জন্যেই। বড় অঙ্ক হলেই যে তার অধীনে বেশি সংখ্যা থাকবে- সম্ভাবনা তত্ত্ব অন্তত এমনটি বলে না!

তবে উল্টোটা কিন্তু বলে। সেটা কেমন?
বাস্তবে দেখা যায় ছোট অঙ্কের অধীনেই বেশি সংখ্যার অস্তিত্ত্ব। দৈবভাবে কোনো একটি সংখ্যা নিলে সেটি ১ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। ২ দিয়ে শুরু হবার সম্ভাবনা আরেকটু কম। ক্রমান্বয়ে সম্ভাবনা কমে যায় বড় অঙ্কের ক্ষেত্রে। তাও আবার একটি প্যাটার্নও মেনে চলে এই ঘটনাটি।বাস্তব পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলালে দেখা যায়, ৯ অংকটি দিয়ে শুরু হওয়া সংখ্যার পরিমাণ ১১ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। অথচ আমরা সম্ভাবনা তত্ত্ব খাটিয়ে শুরুতে সবার জন্যেই ১১ শতাংশ নির্ধারণ করেছিলাম। ৮ দিয়ে শুরু হয় আরেকটু বেশি সংখ্যক সংখ্যা। অন্য দিকে ১ এর দখলে রয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যা! সবচেয়ে বেশি।

এতক্ষণ বলেছিলাম, দৈবভাবে কোনো সংখ্যা নিলে তার সম্ভাবনা এই রকম স্বধর্মচ্যুতি প্রদর্শন করে। কিন্তু, ব্যাপারটি শুধু দৈব বা র‍্যান্ডম ডেটার জন্যেই যে প্রযোজ্য তা নয়। বাস্তব জীবনের বিভিন্ন হিসাব নিকাশ যেমন বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের জনসংখ্যার কথা বলুন অথবা শেয়ার মার্কেট বা নদীর দৈর্ঘ্যের কথাই বলুন- সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় ১ এর জয়জয়কার।

পদার্থিবিজ্ঞানী হয়েও কোন গণিতবিদ বা পরিসংখ্যানবিদের হাতে আবিষ্কার হবার আগেই ফ্র্যাংক বেনফোর্ড এই নিয়মটি আবিষ্কার করে ফেলেন। সালটি ছিল ১৯৩৮। তিনি দেখলেন, বড় অঙ্কদের ক্ষেত্রে সংখ্যার পরিমাণ উল্লখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। সংখ্যার শুরুতে ১ এর আগমণ ঘটে ৩০.১ শতাংশ বার। ২ এর আবির্ভাব ঘটে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ বার। ৩ এর ক্ষত্রে এটা ঘটে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বার। এভাবে চলতে চলতে ৯ এর ভাগে পড়ে মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ সংখ্যা।

বেনফোর্ডের নীতি। বিভিন্ন অঙ্কের ঘটনসংখ্যা 

এটা কেন ঘটে? এটাকি প্রকৃতির ভারসাম্যের বিপরীত কোন কিছু। না, তা হতেই পারে না। এমন ঘটনা ঘটার পেছনেও রয়েছে খোদ গাণিতিক কারণ। আসুন ডুব দেই সেই গণিতে। মনে করুন, আমরা কোনো কারণে লটারি করব। প্রতিযোগী ৯ জন হলে আমরা ১ থেকে ৯ পর্যন্ত অঙ্ক লিখে ৯ খানা টোকেন বানাবো। এই অবস্থায় যে কোনো টোকেনধারীর বিজয়ী হবার সম্ভাবনা সমান। $\frac{১}{৯}$  বা ১১ দশমিক ১ শতাংশ।

এবার ধরা যাক, শেষ মুহূর্তে আরেকজন প্রতিযোগী যুক্ত হলেন। মানে ১০ জন হলেন। তাহলে এবার!
১ অঙ্কটি দিয়ে টোকেন নাম্বার শুরু হবে- এমন হবার সম্ভাবনা এক লাফে উঠে গেছে ১৮ দশমিক ২ পার্সেন্টে। কারণ ১০টি টোকেনের ২ খানাই ১ দিয়ে শুরু। বাড়তে বাড়তে প্রতিযোগী যদি ১১ থেকে ক্রমেই ১৯ জন হয়ে যান, ১ এর কপালও যেন অদৃশ্য ডার্ক এনার্জির প্রভাবে চওড়া হয়ে যায়। ১৯ টোকেনের ক্ষেত্রে এটা দাঁড়াবে ৫৮ শতাংশ।

এবার ২ এর সুযোগ নেবার পালা। যখনি আমরা ২০ নম্বর টোকেন যুক্ত করলাম ২ এর সম্ভাবনা বেড়ে গেল এবং ১ এর সম্ভাবনা একটুখানি কমে গেল। ২৯ পর্যন্ত যেতে যেতে ২ অনেকখানি বাড়ল এবং ১ এর আধিপত্য কমতে কমতে ২ এর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হলো।

টোকেনের প্রথম অঙ্ক তিনে পা দিতে ময়দানে উথান ঘটল তৃতীয় শক্তির! ১, ২ ও ৩ আধিপত্য ভাগাভাগি করে নিল। এভাবে আস্তে আস্তে সবাই নিজের জায়গা দখল করল। কিন্তু ১ একটু বেশিই বুদ্ধিমান। সে যখন নিজের বিপদ বুঝতে পারলো, আবার নতুন চাল চেলে পদার্পণ করলো তিন অঙ্কের জগতে। আবারো বাড়িয়ে ফেললো নিজের সম্ভাবনা। দেখাদেখি, অন্যরাও তাই করতে শুরু করলো। কিন্তু অন্যরা কাছাকাছি আসলেই ১ প্রবেশ করে নতুন অঙ্কের জগতে, সবার আগে আগে।

ফলে, আমরা যখন অনেক বেশি সংখ্যা হিসেব করবো, তখন ১ অন্যদের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকে। যেমন, ১ চার অঙ্কের ঘরে প্রবেশ করলে অন্যদের সেখানে আসতে আরো ১ হাজার করে সংখ্যার নদী পাড়ি দিতে হয়। ১ লক্ষের ঘরে, কোটি বা বিলিয়ন, কোয়াড্রলিয়নের ঘরে প্রবেশ করলে অন্যদের সেখানে আসতে কতো সময় লাগে, চিন্তার ভার আপনার।

কয়েকটি ক্ষেত্রে বেনফোর্ডের নীতিটি প্রযোজ্য নয়। যেমন মানুষের উচ্চতা বা ওজোনের ক্ষেত্রে। অর্থ্যাৎ, মূলত যেসব ক্ষেত্রে মানের নির্দিষ্ট সীমা থাকবে তাতে এই নিয়ম ফল দেবে না। এছাড়াও কাজ হবে না দুই অঙ্কের সংখ্যার ক্ষেত্রেও। জানেনইতো,  সম্ভাব্যতার অন্যতম একটি  নিয়ম হচ্ছে যত বেশি নমুনা (Sample) নেওয়া হবে, প্রকৃত সম্ভাবনা প্রত্যাশিত সম্ভাবনার ততো কাছকাছি আসবে।এটাও মেনে চলে সেই নিয়ম।

কিন্তু, আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই নিয়মটি খাটে ভালোমতোই। ফলে ডেটায় ভুল বের করতে এই নীতিটিও কাজে লাগানো হয়। নিয়মের সাথে গরমিল হলেই বোঝা যায় এটা প্রকৃত উপাত্ত নয়। বরং কেউ বানিয়ে নিয়েছে। অন্য আরও অনেক কিছুর সাথে সাথে এই নিয়মটি আরও  প্রযোজ্য বিদ্যুৎ বিল, রাস্তা নম্বর, মৃত্যু হার এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক ধ্রুবকের ক্ষেত্রেও।

আরেকটি কথা, এই সূত্রটি যে শুধু দশ ভিত্তিক তথা দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির জন্যেই সীমাবদ্ধ- এমন কোন কথা নেই। এটি ১৬ ভিত্তিক হেক্সাডেসিমাল সংখ্যার ক্ষেত্রেও ভালো খাটে।
২৩৭ টি দেশের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত অঙ্কগুলোর শতাংশের হিসাবে দখল। কালো বিন্দুগুলো দ্বারা বোঝানো হচ্ছে বেনফোর্ড নীতির পূর্বানুমান (Prediction)। দুটোর পার্থক্য পরিসংখ্যানের স্বাভাবিক একটি রীতি। 

সূত্র:

[১] লিস্টভার্স
[২] উইকিপিডিয়া
Category: articles
লিখেছেনঃ ড. রহমতুল্লাহ ইমন
(লেখকের অনুমতি নিয়ে ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

তারুণ্য আমাদের পরম আরাধ্য। বয়সকে আটকে রাখতে কত বিচিত্র প্রচেষ্টাই না আমাদের! কত ধরনের গবেষণাই না চলছে নিজেকে চিরসবুজ চিরসতেজ করে রাখতে? সুযোগ থাকলে আমরা অনেকেই হয়তো ফিরে পেতে চাইতাম আমাদের শৈশব। আবার আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন কেবল একটাই স্বপ্ন- কবে আমি বড় হব?

চিন্তা নেই, আপনাদের জন্য পরিসংখ্যান নিয়ে এসেছে সহজ সমাধান! যদি বয়স বাড়াতে চান বেশি করে সবজি খান আর বয়স কমাতে চাইলে খান মাংস ঘি দুধ ডিম। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? অনেকের চোখ উঠেছে কপালে? আসুন আপনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসি একটি গবেষণার পাতা থেকে।

সম্ভবত ২০০৩ সালের ঘটনা। ছাত্রছাত্রীরা উপস্থাপন করছে তাদের এমএসসি’র গবেষণা প্রজেক্ট। একটি পরীক্ষা বোর্ডে প্রফেসর সুশান্ত কুমার ভট্টাচার্যের সাথে বসেছি আমি। ভাল মন্দ সবরকম কাজই আছে সেখানে। আমরা মূলত খেয়াল করছি বেশি যে ছেলেমেয়েটি নিজে নিজেই কাজ করেছে না ফাঁকি দিয়ে ঘরে বসে ফিল্ড ওয়ার্ক সেরেছে অথবা অন্য কাউকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিয়েছে। চলছিল ভালোই।

হঠাৎ একজন ছাত্র তার গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলল সবজি বেশি খেলে বয়স বাড়ে আর ঘি মাংস দুধ ডিম বেশি খেলে বয়স কমে যায়। চমৎকার সব গ্রাফিক্স- নানা ধরনের আকর্ষণীয় বিশ্লেষণ। কোন সন্দেহ নেই ছেলেটি অনেক খেটেই প্রজেক্টটি সম্পন্ন করেছে। সুশান্ত স্যার তাকে ঠিক এই পর্যায়েই থামিয়ে দিলেন,
এই তুমি কী বললে? সবজি বেশি খেলে বয়স বেড়ে যাবে আর ঘি মাংস দুধ ডিম এগুলো বেশি খেলে বয়স কমে যাবে?
'জি, স্যার', ছেলেটি থতমত খেয়ে উত্তর দিল।

মানে? এই কথার মানে কী? বয়স আবার বাড়ে-কমে ক্যামনে? এই ধরো যার বয়স এখন ৩০, বেশি সবজি খেলে কি তার বয়স হয়ে যাবে ৫০? আর যার বয়স ৫০ বেশি ঘি মাংস ডিম খেলে তার বয়স হয়ে যাবে ২০?

ছেলেটি এবার বিপদ বুঝতে পারল। মুহূর্তের ভেতর তার ব্যাগে থাকা গাদা গাদা কম্পিউটার আউটপুট আমাদের সামনে মেলে ধরে বলল।
'স্যার বিশ্বাস করেন আমি কিছুই বানিয়ে লিখিনি, SPSS থেকে যা রেজাল্ট পেয়েছি তাই এখানে লিখেছি।'

না, তার সততা নিয়ে আমাদের মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। আমি তার কম্পিউটার আউটপুট উলটে পালটে দেখলাম। নির্ভরণ বিশ্লেষণের (Regression analysis) ব্যাপক এস্তেমাল করেছে সে তার কাজে। ব্যাখ্যাকারী (explanatory) বা স্বাধীন (independent) চলক হিসেবে সে ব্যবহার করেছিল একটি নকল (dummy) চলক যা ছিল ঐ খাবারগুলো। মাংস, ঘি, ডিম, দুধকে প্রকাশ করা হয়েছিল ১ দিয়ে আর সব্জিকে ০ দিয়ে। ব্যাখ্যাত (explained) বা অধীন (dependent) চলক ছিল বয়স।

SPSS থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছিল যে বয়সের ওপর মাংস, ঘি, ডিম, দুধের প্রভাব ছিল ঋণাত্মক এবং তা ৫% সংশয়মাত্রায় (level of significance) খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আবার যখন অধীন চলককে ঠিক রেখে স্বাধীন চলকের মাংস, ঘি, ডিম, দুধকে প্রকাশ করা হয়েছিল ০ দিয়ে আর সব্জিকে ১ দিয়ে তখন দেখা গেল বয়সের ওপর সব্জির প্রভাব ছিল ধণাত্মক এবং তা ৫% সংশয়মাত্রায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আর এ থেকেই ছেলেটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে সবজি বেশি খেলে বয়স বেড়ে যাবে আর ঘি মাংশ দুধ ডিম এগুলো বেশি খেলে বয়স কমে যাবে।
নির্ভরণ বিশ্লেষণে এমন গ্রাফ পাওয়া গেলে বোঝা যায়, স্বাধীন চলকের মান বাড়লে অধীন চলকের মানও বাড়ে। 

আচ্ছা, বয়স তো একটি সময়ের হিসাব। সময় কি কারও ওপর নির্ভর করে? যদি আমরা টাইম মেশিনে চাপতে পারতাম তাহলে না হয় ভিন্ন কথা। বয়স বা সময় কোনো কিছুর ওপরেই নির্ভর করে না তাই কোনভাবেই একে অধীন চলক হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। উপস্থাপনা শেষে ওকে ল্যাবে নিয়ে গেলাম। বললাম তোমার উপাত্তগুলো দাও। বসলাম ঐ SPSS-এই। এবার শুধু পালটে নিলাম চলকগুলো। বিভিন্ন ধরনের খাবারের তথ্য সম্বন্ধীয় নকল চলকটিকে ধরে নিলাম অধীন চলক আর বয়সকে স্বাধীন চলক।

অধীন চলকের মান যেহেতু শুধু ০ আর ১ সেই হেতু এখানে রৈখিক নির্ভরণ মডেলের পরিবর্তে লজিস্টিক নির্ভরণ মডেল ব্যবহার করতে হল। এবারও ৫% সংশয়মাত্রায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেল। তবে এবার মাংস, ঘি, ডিম, দুধ খাবার ওপর বয়সের প্রভাব পাওয়া গেল ঋণাত্মক, আর সবজি খাবার ওপর বয়সের প্রভাব পাওয়া গেল ধনাত্মক। এবারের ফলাফল কি অর্থপূর্ণ হল? হ্যাঁ, অবশ্যই। এই গবেষণার ফলাফল বলছে, মানুষের বয়স যখন কম থাকে তখন সে মাংস, ঘি, ডিম, দুধ বেশি খায় আর যখন তার বয়স বেড়ে যায় সে বেশি খায় সবজি। ছেলেটির গবেষণার সব কিছুই ঠিক ছিল, শুধু স্বাধীন আর অধীন চলকের স্থান ওলট পালট হওয়ায় কী হাস্যকর ফলাফলই না পাওয়া গিয়েছিল!

এ খবর আমাদের বিভাগ ছাড়িয়ে চলে এসেছিল বাইরে। সন্ধ্যায় ক্লাবে বাংলা বিভাগের প্রফেসর সফিকুন্নবী সামাদীর সাথে দেখা। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বললেন কি হে, তোমরা নাকি বয়স কমাবার ফর্মুলা আবিষ্কার করে ফেলেছ? আমি নিশ্চিত ছেলেটি পরে সহপাঠীদের কাছ থেকে নানা ধরনের বিদ্রূপের শিকার হয়েছিল। কিন্তু এটি কি শুধু তারই ত্রুটি? সে একজন শিক্ষানবিশ, তার ভুল ত্রুটি হতেই পারে। কিন্তু প্রত্যেক প্রজেক্টের একজন করে তত্ত্বাবধায়ক থাকেন যারা বিভাগের শিক্ষক। তাদেরও তো কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে। ছেলেটির তত্ত্বাবধায়ক যদি একটু মনোযোগ দিয়ে তার কাজটি দেখতেন তাহলে এমন বিপত্তি হত না।

এই ঘটনা থেকে আমাদের সবার জন্য শিক্ষণীয় রয়েছে অনেক কিছুই। যে কোনো গবেষণায় ‘কমন সেন্স’ এর কোনো বিকল্প নেই। কম্পিউটারের ওপর আমাদের অতি নির্ভরতা কমাতে হবে। এখনও এটা একটা নির্বোধ যন্ত্র বৈ কিছু নয়। আপনি যেভাবে চালাবেন এটা সেভাবেই চলবে। আর এই কম্পিউটার প্যাকেজের যুগে আপনি কিছু উপাত্ত ঢুকিয়ে এ বোতাম সে বোতামে টিপ দিলে নানা ধরনের ফলাফল আসবেই। আমরা অবশ্যই কম্পিউটার ব্যবহার করব, ব্যাপকভাবেই তা করব। কিন্তু আপনাকেই নির্ধারণ করে দিতে হবে আপনি কী চান? কম্পিউটার জানে না কোনটি স্বাধীন আর কোনটি অধীন চলক। এর ব্যত্যয় ঘটলে এমন হাস্যকর অর্থহীন পরিসংখ্যানে ভরে উঠবে আমাদের চারিপাশ।

লেখক: অধ্যাপক, গাণিতিক বিজ্ঞান বিভাগ, বল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
Category: articles
লিখেছেনঃ ড. রহমতুল্লাহ ইমন
(লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

জুয়া পৃথিবীর আদিমতম খেলা। যদিও প্রায় প্রতিটি ধর্মেই জুয়া খেলাকে পাপ বলা হয়েছে তারপরেও এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। ক্রিকেটের নামে আইপিএল বা বিপিএল-এ যা হচ্ছে এটা জুয়া ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশের পান সিগারেটের দোকানে পর্যন্ত বেটিং এর কার্ড পাওয়া যাচ্ছে- ভাবাই যায় না।

যে সময়ের কথা বলছি সেটা সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝি। সমগ্র বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপে জুয়া তখন অভিজাতদের খেলা। পোলোর মত বেশ কিছু খেলা রাজাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমনকি যে ক্রিকেট আজ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের খেলায় পরিণত হয়েছে একসময় তা ছিল শুধুই লর্ডদের খেলা, সাধারণ মানুষের এই খেলায় অংশ নেয়া তো দূরের কথা, খেলার মাঠে দর্শক হিসেবেও প্রবেশাধিকার ছিল না। কোনো কোনো জুয়াতে তো মাথাই কাটা পড়ত বিজিতের। আর খেলা যেহেতু রাজ রাজাড়াদের সেখানে পুরষ্কারের মূল্যও ছিল অনেক বেশি। পুরষ্কার হিসেবে থাকত রাজ্য, মূল্যবান মণি মানিক্য, এমনকি রাণীও। যে রাজার শতাধিক রাণী আছে তিনি দু চারজন রাণীর ওপর বাজি ধরবেন এতে আর অবাক কী? ইউরোপে জুয়ার তীর্থস্থান ছিল মন্টি কার্লো। এখন যেমন লাস ভেগাস তখন ছিল মন্টি কার্লো। সেখানে খেলা ছিল জুয়াড়িদের পরম আরাধ্য। আর কত নতুন খেলার উৎপত্তিই না হয়েছে এই শহরে। আর এভাবে একদিন জুয়া খেলা থেকেই উদ্ভব হল সম্ভাবনা তত্ত্বের, যাকে আমরা বলে থাকি পরিসংখ্যানের হৃৎপিণ্ড।


তো সে সময়ের এক খেলাকে কেন্দ্র করে বাঁধল বিপত্তি। দু’জন খেলোয়াড় খেলছে একে অপরের বিরুদ্ধে। যিনি প্রথম ৪ টি ম্যাচ জিতবেন তিনি হবেন এই খেলায় বিজয়ী। খেলায় কোন ড্র এর সুযোগ নেই, ড্র হলে টাইব্রেক করে ম্যাচের নিষ্পত্তি হবে। আর যিনি বিজয়ী হবেন পুরষ্কারের পুরো অর্থই পাবেন তিনি। সে আমলে এটাই ছিল রীতি। এখন যেমন বিজয়ী ও বিজিত উভয় দলের জন্যই আছে প্রাইজমানি, চ্যাম্পিয়নের পাশাপাশি রানার আপও পুরষ্কার পান, তখন এসবের বালাই ছিল না। লুজার ইজ এ লুজার। খেলায় হেরেছিস আবার টাকা চাস, লজ্জা নেই তোর?

আবার খেলায় ফিরে আসি। ধরা যাক খেলোয়াড় দুজনের নাম A এবং B। A জিতেছে ১ম, ২য় ও ৪র্থ ম্যাচ আর B জিতেছে ৩য় ম্যাচ। অর্থাৎ A যখন ৩-১ এ এগিয়ে আছে তখন অনিবার্য কারণ বশত খেলাটি পরিত্যক্ত হল। যেহেতু খেলায় কেউ বিজয়ী হয়নি আয়োজকেরা পুরষ্কারের অর্থ দুই খেলোয়াড়ের মাঝে ভাগ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক্ষেত্রে ন্যায্য ভাগাভাগিটা কেমন হবে? যেহেতু A ৩-১ এগিয়ে আছেন তাই আয়োজকেরা এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কারের মোট অর্থ ৪ ভাগ করে A কে ৩ ভাগ আর B কে ১ ভাগ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। গণিতের আনুপাতিক নিয়ম অনুসারে এটাই ন্যায্য ভাগ।

B এই ভাগ মেনে নিলেন, কিন্তু আপত্তি জানালেন A। যদিও তিনি খেলায় বিজয়ী হননি, আর ১ টা ম্যাচ জিতলেই তিনি হয়ে যেতেন পুরো টাকার মালিক। তিনি যেন বিজয়ের একটা গন্ধ পেতে শুরু করেছিলেন। তাঁর মন কিছুতেই এই ভাগাভাগি মানছিল না। গণিতের হিসাবে এই ভাগ ঠিক আছে, কিন্তু কোথায় কী যেন ঠিক নেই, তাঁর আরও বেশি পাওয়া উচিত। তিনি দ্বারস্থ হলেন আরেকজন বিখ্যাত জুয়াড়ি এবং সৌখিন গণিতবিদ শোভার ডি মিরির (Chevalier de Méré) কাছে। ডি মিরি প্রথমে এর কোনো গুরুত্ব দিলেন না। A চলে গেলেন প্রখ্যাত গণিতবিদ ব্লেইস প্যাসকাল (Blaise Pascal) এর কাছে। প্যাসকালও প্রথমে একে গুরুত্ব দিতে চাননি। ভাগ তো ঠিকই আছে- A ৪ খেলায় জিতেছে ৩ টা ম্যাচ, B জিতেছে ১টা। তাহলে চারভাগের ৩ ভাগ আর ১ ভাগ ঠিকই তো আছে।

কিন্তু A তবুও নাছোড়বান্দা। অতঃপর ডি মিরি, প্যাসকাল এবং আরও একজন প্রথিতযশা গণিতবিদ পিয়ের ডি ফারমা (Pierre de Fermat) বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন। তাঁরা যেভাবে এর সমাধান করেছিলেন তা একটু জটিল। সবার সহজে বোঝার জন্য এর একটা সরল পাঠ এখানে উপস্থাপন করছি।

আমরা জানি যে ৪ টা ম্যাচ হবার পর খেলাটি পরিত্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু যদি খেলাটি নির্বিঘ্নে চলতে পারত তাহলে কী হতে পারত এর ভবিষ্যত ফলাফল? দুইজন খেলোয়াড় খেলছে সর্বোচ্চ ৪ টি ম্যাচ জেতার জন্য এবং এখানে ড্রয়ের কোন সুযোগ নেই। একজন খেলোয়াড় যদি টানা ৪ ম্যাচ জেতে তাহলে ৪ ম্যাচ পরেই খেলা শেষ, কিন্তু এর অন্যথাও তো হতে পারে। তবে যাই হোক কোনভাবেই এই খেলা ৭ ম্যাচের বেশি গড়াবে না, কেননা ৭ ম্যাচ শেষে কেউ না কেউ অবশ্যই ৪ ম্যাচ জিতে যাবে এবং সেই হবে বিজয়ী। আলোচ্য খেলাটিতে ৪ টি ম্যাচ হয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ আর হতে পারত সর্বোচ্চ ৩ টি ম্যাচ।
এখন এক নজরে দেখে নেয়া যাক এই ৩ ম্যাচে কী কী ফলাফল হতে পারত এবং তাতে কার জেতার সম্ভাবনা ছিল কতটা? (টেবিল বুঝতে হলে মনে করে দেখুন, বলা হয়েছিল, ৩য় ম্যাচ B জিতেছিল। সেই হিসেবেই সাজানো হয়েছে।)

যা হতে পারত চূড়ান্ত ফলাফল বিজয়ী
AAA AABAA A
AAB AABAA A
ABA AABAA A
ABB AABAA A
BAA AABABA A
BAB AABABA A
BBA AABABBA A
BBB AABABBB B

৩ টি খেলায় ৮ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল আসতে পারত। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে প্রথম ৪ টি ফলাফলে ৫ম ম্যাচেই খেলা শেষ হয়ে যেত এবং A ৪-১ ব্যবধানে জয়লাভ করত। এর পরের ৩ টি ফলাফল বলছে খেলাটি চলত ৬ষ্ঠ ম্যাচ পর্যন্ত এবং তাতে A ৪-২ ব্যবধানে জিতে যেত। ৭ম ফলাফল বলছে খেলা গড়াতে পারত ৭ম ম্যাচ পর্যন্ত এবং এখানেও বিজয়ী হত A ৪-৩ ব্যবধানে। ৮ম ফলাফল বলছে খেলাটি ৭ম গেমেই নিষ্পত্তি হত এবং কেবলমাত্র এই খেলাতেই জয় ছিনিয়ে নিতে পারত B ৪-৩ এই ব্যবধানে।

যেহেতু ৮ টি সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে ৭ টিতে জয় পেত A আর ১ টিতে B, মোট অর্থের ৮ ভাগের ৭ ভাগ পাওয়া উচিৎ A এর, আর বাকি ১ ভাগ B এর। অর্থাৎ A আগে যেখানে ৭৫ ভাগ পেতেন এখন সেখানে পাচ্ছেন ৮৭.৫% অর্থ। এই নতুন বন্টনে B এর ভাগ কিন্তু অর্ধেক কমে গেল আর তা যুক্ত হল A এর ভাগের সাথে। পুরস্কার যখন মোটা অংকের তখন এই বাড়তি ভাগও বিশাল একটা ব্যাপার।

তা A আর B কে কত পেয়েছিল তা ইতিহাসের খাতায় জমা থাক, আমরা তো পেয়ে গেলাম এক বিশাল হীরকখনি- পরিসংখ্যানের হৃৎপিণ্ড সম্ভাবনাতত্ত্ব। সম্ভাবনার উৎপত্তিস্থল হিসেবে আলাদা মর্যাদা পেল মন্টিকার্লো। এই মুহূর্তে পরিসংখ্যানে সবচে বেশি ব্যবহৃত প্রতিরূপক (simulation) পদ্ধতির নামকরণ করা হয়েছে মন্টিকার্লোর নামেই। আর সম্ভাবনার ডানায় চেপে আমরা আজ বিচরণ করছি ভবিষ্যতের অজানা ভুবনে। সম্ভাবনাতত্ত্ব আজ পরিণত হয়েছে জ্ঞানবিজ্ঞানের টাইমমেশিনে।

লেখক: অধ্যাপক, গাণিতিক বিজ্ঞান বিভাগ, বল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
Category: articles

Saturday, September 16, 2017

লিখেছেনঃ ড. রহমতুল্লাহ ইমন
(লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে ফেসবুক থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

এ জগতে কত রকম পিতাই তো আছেন। আপনি হতে পারেন সন্তানের জন্মদাতা পিতা, পালক পিতা, দত্তক পিতা, স্ত্রীর সন্তান সেই সূত্রে পিতা সাধারণ ভাষায় যাকে বলে সৎ পিতা। আবার যারা একটি জাতির মাঝে জাতিসত্ত্বার জন্ম দিয়ে থাকেন তাঁদের বলা হয় জাতির পিতা। এমনকি এই জগতের যিনি অধীশ্বর তাঁকেও বলা হয় জগৎ পিতা। কিন্তু এত পিতার ভিড়েও কেউ কখনো পরিসংখ্যানিক পিতা (statistical father) এই শব্দটি শুনেছেন কি?

যত রকম পিতাই থাকুক না কেন পিতা বলতে জন্মদাতা পিতাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। পিতা হবার আনন্দ, উত্তেজনা আর তৃপ্তি যে কতটা তা যারা বাবা না হয়েছেন তাদের বোঝানো বেশ কষ্টের। তবে এ মধুর তৃপ্তি বেদনায় পর্যবসিত হয়ে যায়, যখন সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ সংশয় জাগে পিতার মনে। হাল জামানায় ডিএনএ বা আরও অনেক পরীক্ষার মাধ্যমে পিতৃত্ব নিশ্চিত করা যায় কিন্তু অতীতে বিষয়টি এত সহজ ছিল না।

মূল ঘটনায় আসি। সময়কাল ১৯৪৬। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর হ্যাডলাম তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেবার অভিপ্রায়ে আদালতে এক মামলা ঠুকে দিলেন। হ্যাডলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে যাবার ৩৪৯ দিন পর তাঁর স্ত্রী একটি সন্তানের জন্ম দেন। সাধারণভাবে একটি সন্তান জন্মানোর সময়কাল ৯ মাস ১০ দিন অর্থাৎ ২৮০ দিন। সেক্ষেত্রে ৩৪৯ দিনের ব্যবধান মেজর হ্যাডলামের কাছে খুবই দীর্ঘ মনে হয় এবং তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে তিনি এই সন্তানের জনক নন।

দীর্ঘ শুনানি শেষে বিচারক অভিমত দেন যে ৩৪৯ দিনের ব্যাবধান দীর্ঘ হলেও অসম্ভব নয়। আর সে কারণে তিনি মেজর হ্যাডলামের আবেদনটি খারিজ করে দেন। এর কিছুদিন পর আরেকজন ব্রিটিশ মেজর একই রকম অভিযোগ নিয়ে দ্বারস্থ হন আরেকটি আদালতে। এক্ষেত্রে মেজর তার স্ত্রীকে ছেড়ে গিয়েছিলেন ৩৪০ দিন আগে। এক্ষেত্রে অবশ্য বিচারক সন্তান জন্মের জন্য ৩৪০ দিন অবিশ্বাস্যরকম দীর্ঘ বিবেচনায় মেজরকে অনুমতি দেন বিবাহ বিচ্ছেদের। আরেকটি মামলায় এক ব্যক্তি স্ত্রীকে ত্যাগ করার অনুমতি পান যেখানে ব্যবধান ছিল ৩৩১ দিনের।

বিবাহ বহির্ভূত প্রেম, পরকীয়া, অবৈধ সন্তানের জন্ম এসব চটকদার ঘটনা সবসময়েই মিডিয়ার কাছে বাড়তি আকর্ষণ লাভ করে থাকে। ব্রিটিশ সংবাদপত্রের পাতার বড় অংশ জুড়ে স্থান পেতে থাকে এসব ‘চাটনি’ খবর। সেই সাথে আরেকটি শব্দ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে- বহির্মান বা outlier। পরিসংখ্যানের পরিভাষায় একেবারেই অস্বাভাবিক মানের কোনো উপাত্তকে বলা হয় বহির্মান। সন্তান জন্ম দেবার সময় হিসেবে এই ৩৩১ দিন, ৩৪০ দিন, ৩৪৯ দিন বহির্মান কি না এই প্রশ্নগুলো উঠতে থাকে ব্রিটিশ সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। আর এর মাধ্যমেই বহির্মান শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

জনান্তিকে বলে রাখি বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পি এইচ ডি গবেষণার মূল প্রতিপাদ্যই ছিল এই সব বহির্মান সনাক্তকরণ এবং এর প্রতিকার। আর সে কারণেই এই অধম রহমতউল্লাহ ইমন হ্যাডলাম মিঞা বিবি এবং অন্যান্য যুধ্যমান দম্পতিদের কাছে ঋণী।

আবার মূল গল্পে ফেরা যাক। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে। হাজার হাজার সৈন্য গিয়েছেন যুদ্ধে- তাদের অনেকের স্ত্রীই সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো বেশ দেরিতে। এই নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে সন্দেহ, অবিশ্বাস। মামলার পর মামলা আসছে আদালতে আর যেহেতু বিচারবোধ ছাড়া পিতৃত্ব নির্ধারণের কোনো স্বীকৃত পথ জানা নেই বিচারকেরাও দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক সাংঘর্ষিক রায়। আর এগুলো সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন আপিল আদালত।

এক মামলার রায় অন্য মামলায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৩৩১ দিন যদি সন্তান জন্ম দেবার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যবধান হয় তবে ৩৪৯ দিন স্বাভাবিক হয় কীভাবে? উপায়ন্তর না দেখে ব্রিটিশ কোর্ট অফ জাস্টিস শরণাপন্ন হলেন ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং রয়্যাল স্ট্যাটিসক্যাল সোসাইটির। পিতৃত্ব নির্ণয়ের একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি খুঁজে বের করতেই হবে।

শুরু হল দক্ষ যজ্ঞ। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং রয়্যাল স্ট্যাটিসক্যাল সোসাইটি সন্তানসম্ভবা ১৩,৬৩৪ জন মহিলাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে তাদের সন্তান জন্মের সময় নির্ধারণ করলেন। পরিসংখ্যানবিদদের জন্য বিশেষ সন্তোষের কারণ ছিল এই যে জন্মসময়গুলো একটি আয়তলেখ (histogram) এর মাধ্যমে উপস্থাপন করলে দেখা গেল এটি পরিমিত নিবেশন (normal distribution) এর রূপ নিয়েছে। আয়তলেখের ঠিক কেন্দ্রেই ছিল গড় মান ৪০ সপ্তাহ বা ২৮০ দিন। আর এ কথাও অনেকেরই জানা যে উপাত্ত যখন পরিমিত নিবেশনে বিন্যস্ত থাকে তখন গড় থেকে ৩ পরিমিত ব্যবধান (standard deviation) নিয়ে কোন সীমানা নির্ধারণ করলে তা উপাত্তের ৯৯.৭% অর্থাৎ প্রায় পুরোটাই ধারণ করে থাকে।

পরিমিত নিবেশন বা বেল কার্ভের চেহারা।

সন্তান জন্মের গড় সময়কালের সাথে ৩ পরিমিত ব্যবধান বিস্তার নিলে তা ৩৬০ দিন পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। পরিসংখ্যানের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই হাউজ অফ লর্ডস ১৯৫১ সালে আইনজারি করে দিলেন যে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ৩৬০ দিনের মধ্যে যেসব শিশুর জন্ম হবে স্বামীকে সেই শিশুর পিতৃত্ব মেনে নিতে হবে। ডি এন এ পদ্ধতিতে সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণের রীতি চালু হবার আগ পর্যন্ত এটাই ছিল সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণের আইনগত পন্থা। মনে যত দ্বিধা দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন সন্তানের পিতৃত্ব আপনাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। বাস্তবে যাই হোক না কেন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বনে যাওয়া এসব পিতাদের ক্ষেত্রে তখন এক বিশেষ অভিধা জুটেছিল- পরিসংখ্যানিক পিতা।

লেখকঃ অধ্যাপক, ম্যাথেম্যাটিক্যাল সায়েন্সেস, বল স্টেট ইউনিভার্সিটি। 

আরও পড়ুনঃ
☛ বেল কার্ভের জাদু
Category: articles

Friday, September 15, 2017

আপনাদের নিশ্চয়ই একিলিস ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার কথা মনে আছে। যেখানে কচ্ছপ গ্রিক বীরকে গতির চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। কিন্তু শেষমেষ হার হয় কচ্ছপেরই। কাজটা যদিও প্র্যাকটিকেলি বড়ই সহজ ছিল, কিন্তু গণিতের অপপ্রয়োগ খাটিয়ে কচ্ছপ তাত্ত্বিকভাবে জিতে নিতে চেয়েছিল রেসটি।

এবারের লড়াইয়ে প্রাণী আছে একটিই। লড়াই করতে হবে একটি দড়ির সাথে। যে সে দড়ি নয়, সে এক রাবারের দড়ি। প্রতি মুহূর্তে এর দৈর্ঘ্য প্রসারিত হচ্ছে। এমনই এক দড়ির উপর দিয়ে পিঁপড়াটিকে পার হতে হবে।

খুলেই বলা যাক।

শুরুতে দড়ির দৈর্ঘ্য ছিল ১ মিটার (৩ দশমিক ৩ ফুট)। পিঁপড়াটি এই রাবারের দড়িটির উপর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১ সেন্টিমিটার বেগে হেঁটে যাচ্ছে। দড়ি যদি স্বাভাবিক থাকতো, তাহলে ১ মিটার তথা ১০০ সেন্টিমিটার পথ পিঁপড়াটি ১০০ সেকেন্ডেই পার হয়ে যেত। তাহলে অবশ্য আর এই লেখাটি লেখা হতো না।

কিন্তু রাবারের দড়িটি প্রতি সেকেন্ডে ১ কিলোমিটার হারে সুষমভাবে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে। মানে ২য় সেকেন্ডে দড়ির দৈর্ঘ্য হবে ২ কি.মি.। ৩য় সেকেন্ডে দৈর্ঘ্য হবে ৩ কি.মি. ইত্যাদি। তবে বৃদ্ধিটা হচ্ছে সুষমভাবে। দড়ির প্রতিটা অংশে সামান্য অংশ করে বেড়ে বেড়ে।

এবার কি তাহলে পিঁপড়া কোনোদিন দড়িটি পার হতে পারবে? উত্তর হলো, হ্যাঁ পারবে।

অনেকে চোখ কপালে তুলে ভাবছেন, এই দড়ি পিঁপড়াটি পার হবে কিভাবে? এও কি সম্ভব? শুধু সম্ভবই নয়, দড়ির যে-কোনো দৈর্ঘ্যের জন্যেই এটা সম্ভব। এমনকি সম্ভব পিঁপড়ার যে-কোনো বেগের জন্যেও।

প্রাথমিকভাবে অবশ্য কাজটাকে অসম্ভবই মনে হবে। সহজ কারণ, চলার বেগের চেয়ে যদি পথের দৈর্ঘ্য বড় হয়ে যাবার বেগ বেশি হয় তাহলে আর কী-ইবা হতে পারে। কিন্তু, পিঁপড়ার পক্ষে কাজটি করা সম্ভব। তাতে কতো সময় লাগবে, তা আমরা পরে দেখবো। আগে দেখি, কীভাবে সম্ভব হবে।

চলা শুরুর পূর্ব মুহূর্তে পিঁপড়ার সামনে পুরো পথ তথা ১০০% দড়ি পড়ে আছে, যা তাকে পার হতে হবে। ১ সেকেন্ড পরে দড়ির দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটার প্রসারিত হয়ে গেল। ওদিকে পিঁপড়াও কিন্তু চলেছে। ফলে, আগে যেখানে পথ বাকি ছিল ১০০%, এখন কিন্তু সেই ভগ্নাংশ আরো কমে গেছে। ২য় সেকেন্ডে তার সামনে হিসাব থাকবে ২ কিলোমিটার (মানে ২,০০০ মিটার) পথ। এর একটি অংশ সে ইতোমধ্যেই পার হয়েছে। ফলে বাকি পথের দৈর্ঘ্য আর ১০০% নয় কিন্তু। অবশ্য প্রকৃতপক্ষে আরেকটু কম পাড়ি দিতে হবে। কেন, বলছি একটু পরই।

পরের সেকেন্ডে সে আরো ১ সেন্টিমিটার চলল। দড়িও প্রাসারিত হয়ে গেল আরো এক কিলোমিটার। কিন্তু খেয়াল করার বিষয় হলো দড়িটি শুধু পিঁপড়ার সামনের দিকে প্রসারিত হচ্ছে না, পেছনেও হচ্ছে। ব্যাপারটি যদি এমন হতো যে, দড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে ১ কিলোমিটার করে নতুন দড়ি যুক্ত হচ্ছে, তাহলে কিন্তু আজীবন চললেও পথ কোনক্রমেই শেষ হতো না।

কিন্তু এক্ষেত্রে পিঁপড়ার সামনে যেমন দড়ি বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে পেছনেও। আমরা আগেই বলেছি বৃদ্ধিটা হচ্ছে সুষমভাবে। ফলে, একই সাথে সামনে পড়ে থাকা দূরত্ব যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ফেলে আসা পথও। আর পিঁপড়া যতোই সামনে এগোচ্ছে, ততোই ফেলে আসা পথের ক্ষেত্রে প্রসারণ বাড়ছে এবং উল্টোভাবে কমে যাচ্ছে সামনে পড়ে থাকা পথের ভগ্নাংশ।

ফলে, এক সময় পিঁপড়াটি সত্যিই দড়িটি পার হয়ে যাবে। কিন্তু একটি শর্ত আছে। প্রাণিটিকে অবশ্যই অনেক অনেক... অনেক দীর্ঘায়ু পেতে হবে। কেননা, এই পথ পাড়ি দিতে তাকে  $2.8 x 10^{43,429} সেকেন্ড পথ চলতে হবে।

আপনি চাইলে ২৮ এর পর ৪৩৪২৮ টি শুন্য বসিয়ে দেখতে পারেন সংখ্যাটি কতো বড় হয়। সত্যি কথা হলো, মহাবিশ্বের বর্তমান বয়সও (প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর) কিন্তু এতো হয়নি।

কিন্তু কাজটিকে কেন অসম্ভব মনে হয়?
এই কাজটিকে অসম্ভব মনে হবার দুটি কারণ থাকতে পারে।

১। দড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে শুনে মনে হচ্ছে দড়ির শেষ প্রান্তে নতুন করে দড়ি যুক্ত হচ্ছে। বাস্তবে সম্পূর্ণ দড়িটিই প্রসারিত হচ্ছে, পিঁপড়ার সামনেও আবার পেছনেও।

২। পিঁপড়ার বেগ দড়ির প্রসারণ হারের তুলানায় নগণ্য বলে। আর এজন্যেই সময় অনেক বেশি লাগছে। এতই বেশি যে একে অসম্ভব মনে হয়ে যাচ্ছে।

এ তো সম্পূর্ণ কাল্পনিক ভাবনা। এবার চলুন এ রকমই একটু বাস্তব উদাহরণ দেখি। আমরা জানি, আমাদের এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। যতোই প্রসারিত হচ্ছে ততোই প্রসারণের হারও বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলাফলস্বরূপ আমরা দেখি গ্যালাক্সিরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে সরার এই বেগ  ছাড়িয়ে যাচ্ছে আলোর বেগকেও।

আলোর বেগকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে- কথাটি বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি। আলোর বেগই সর্বোচ্চ সম্ভাব্য বেগ- এই কথাটি প্রযোজ্য মহাবিশ্বের অভ্যন্তরীণ স্থান ও কালের জন্যে। অন্য দিকে, মহাবিশ্বের প্রসারণ আসলে এর নিজস্ব স্থান কালের প্রসারণ। স্থানের (Space) অভ্যন্তরস্থ কোনো নিয়ম স্থান নিজে মানতে বাধ্য নয় বলেই এমনটি হচ্ছে।

আবার মূল প্রসঙ্গে আসি। কোনো গ্যালাক্সি যদি আমাদের থেকে আলোর চেয়েও বেশি বেগে দূরে সরে যায়, তাহলে ঐ গ্যালাক্সিকেকি আমরা দেখতে পাবো? প্রশ্নটা অনেকটাই পিঁপড়ার দড়াবাজির মতো যেখানে আমরা পিঁপড়ার জায়গায় আলো আর দড়ির জায়গায় প্রসারণশীল স্থানকে চিন্তা করতে পারি । আলো তার চেয়ে বেশি বেগে প্রসারিত হওয়া স্থান ভেদ করে আমাদের চোখে পৌঁছতে পারবে কিনা? একেও আগের মতোই অসম্ভব মনে হয়।

একটু আগেই আমরা দেখলাম, অপেক্ষাকৃত বেশি বেগে প্রসারমান কোন বস্তুকেও অপেক্ষাকৃত কম বেগ নিয়েও পাড়ি দেওয়া যায়। কিন্তু আলোর ক্ষেত্রে একটু সমস্যা আছে। পিঁপড়ার ক্ষেত্রে রাবার প্রসারিত হচ্ছিল ধ্রুব বেগে। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারণ হার ধ্রুব নয়, সময়ের সাথে সাথে বর্ধনশীল। ফলে যথেষ্ট দূরের গ্যালাক্সির আলো পৃথিবীতে নাও পৌঁছতে পারে।  কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের গ্যলাক্সির আলো পিঁপড়ার মতোই সফল হতে পারবে।

সূত্রঃ
১। লিস্টভার্স
২। উইকিপিডিয়া
Category: articles

Thursday, September 14, 2017

যারা জানেন না, তাদেরকে আগে কানে কানে বলে দিচ্ছি প্যারাডক্স কী জিনিস। অভিধানের ভাষায় পরস্পর স্ববিরোধী ঘটনা বা বক্তব্যকে প্যারাডক্স বলে। অনেক সময় অবশ্য সত্য ঘটনাকেও প্যারাডক্স মনে হতে পারে। মনে করা হয়, এর আদি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় চীনে।

চীন দেশে একবার এক লোক বল্লম ও ঢাল বিক্রি করছিল। সে দাবী করল, আমার কাছে এমন এক বল্লম আছে যা যে কোন কিছু ভেদ করতে পারে। সে আবার দাবী করল, আমার কাছে এমন এক ঢাল আছে, যা যে কোনো কিছু ঠেকিয়ে দিতে পারে। এ শুনে এক বুদ্ধিমান কিশোর গিয়ে তাকে বলল,
আমি যদি এই বল্লম দিয়ে এই ঢালে আঘাত করি, তাহলে কী হবে?
এ থেকেই জিজিয়াং মাওদুং বা 'স্ব-বিরোধী' (Self-contradictory) পরিভাষাটির উদ্ভব।

আবার, আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয় অথচ সত্য- এমন ঘটনাও প্যারাডক্স।

আজ আমরা এমন একটি প্যারাডক্স নিয়েই কথা বলব।

আচ্ছা, বলুন তো আলুতে কত ভাগ পানি থাকে?
হ্যাঁ, ৭৯ ভাগ।

কিন্তু সেটা ভুলে গিয়ে ধরা যাক, আলুর ওজোনের ৯৯ শতাংশই হলো পানি। এবার মনে করুন, আপনি এ রকম ১০০ কেজি আলু কিনে বাসায় নিয়ে আসলেন। যেহেতু একটু গবেষণা প্রিয়, তাই আপনি আলুগুলোকে স্টক করে রাখার চেয়ে গবেষণার স্যাম্পল বানিয়ে দিনভর ঘরের বাইরে রেখে দিলে। যতক্ষণ না আলুতে পানি শুকিয়ে পারসেন্টেজ ৯৯% থেকে ৯৮% না হলো, ততক্ষণ বাইরেই রেখে দিলে। এবার, একটু হিসাব নিকাশ করে বলুন দেখি, এই পরিমাণ পানি হারানোর পর আলুগুলোর ওজোন (ভর) কত হলো?


উত্তর যদি হয় ৫০ কেজি, তাহলে হিসাব সঠিক।

মনে হয়, আমার কথাটি মানা যাচ্ছে না। এই জন্যেই তো শিরোনাম দিয়েছি 'প্যরাডক্স'।

কিন্তু যা তা বললেই তো হবে না, যুক্তিও থাকতে হবে। তাই প্রমাণের ভার নিজের কাঁধেই রাখলাম।

প্রমাণ দেখব তিনটে। ১ ও ২ নং যুক্তিতে না বুঝলে বা না মানতে চাইলে (যদিও তার কোনো কারণ নেই) ৩ নং প্রমাণ দেখুন। এটা একটু বেশি গাণিতিক।

প্রমাণ ১:
আগে পানি বাদে ওজোন (শুধু আলুর ওজোন) ছিল ১ কেজি। কারণ ১০০ এর ১% হলো ১। এখন শুধু আলু আছে ২%। বাকি ৯৮% পানি। এখন বের করতে হবে ১ কেজি কত কেজির ২%। হুম, ৫০। কারণ, ১০০ এর ২% তো ২। তার মানে, ৫০ এর ২% হলো ১।

অতএব, উত্তর ৫০ কেজি।

প্রমাণ ২:

আগে ৯৯ কেজি ছিল পানি। ১ কেজি ছিল শুধু আলু। তার মানে অনুপাত হলো ১:৯৯।
পানি ৯৮% হয়ে গেলে শুধু আলু হয়ে গেল ২%। এখন অনুপাত তাহলে ২:৯৮ বা ১:৪৯।

এখন শুধু আলুর ওজোন যেহেতু ১ কেজিই থাকল, তার মানে বাকি ৪৯ কেজি হলো পানি। যোগফল ৫০ কেজি।

প্রমাণ ৩:

প্রতিটি আলুতে পানির পরিমাণ ৯৯%। % চিহ্ন উঠিয়ে লিখলে হয় ০.৯৯।
তাহলে, ১০০ টি আলুতে পানির পরিমাণ ০.৯৯ × ১০০।

মনে করি, পানি কমার পর আলুগুলো সব মিলিয়ে 'ক' পরিমাণ পানি হারালো।
তাহলে, এখন আলুর ওজোন (১০০ - ক)। যেহেতু শুরুতে ওজোন ছিল ১০০ কেজি।

আগের মতোই, (১০০-ক) পরিমাণ আলুতে পানির পরিমাণ ০.৯৮ × (১০০-ক)।
আর, এই দুই ওজোনের পার্থক্যই হল ক।
তাহলে, ০.৯৯ × ১০০ - ০.৯৮ × (১০০ - ক)  = ক
বা, ৯৯ - (৯৮ - ০.৯৮ক) = ক
বা, ৯৯ - ৯৮ + ০.৯৮ক = ক
বা, ১ + .৯৮ক = ক
বা, ক - ০.৯৮ ক = ১
বা, ০.০২ ক = ১
বা, ক = $\frac{১}{০.০২}$
       = ৫০
অতএব, হারানো পানির ওজোন ৫০ কেজি। তাহলে বাকিও আছে (১০০-৫০) = ৫০ কেজি।
এখানে কিন্তু কোনো চাতুরি নেই, যেভাবে চাতুরী করে ১ =২ ইত্যাদি প্রমাণ করা হয়।

সূত্রঃ উইকপিডিয়া
Category: articles
[লেখাটি ইতোপূর্বে পাই জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।]

দাবা খেলা আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে পুরষ্কার প্রদান নিয়ে মজার ঘটনাটি আমরা সবাই কম বেশি জানি। দাবার উদ্ভব পূর্ব ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্যে। শুরুর দিকে এর নাম ছিল চতুরঙ্গ। কে এই বুদ্ধির খেলা আবিষ্কার করেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে জানা যায়, তিনি স্বৈরাচারী রাজাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে প্রত্যেকেই, এমনকি রাজ্যের তুচ্ছ মানুষটিও কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেন।


যাই হোক, রাজা চতুরঙ্গে মুগ্ধ হলেন। তিনি আবিষ্কর্তাকে পুরষ্কার দিতে চাইলেন।

বললেনঃ কী চাই তোমার?

উদ্ভাবক বললেন,
বোর্ডের প্রথম ঘরের জন্য আমি একটি গম চাই। ২য় ঘরের জন্যে ২টি, ৩য় ঘরের জন্য চারটি...। এভাবে প্রত্যেক ঘরের জন্য আগের ঘরের দ্বিগুণ দিয়ে দিয়ে ৬৪ ঘরে যত গম হয় তা দিলেই চলবে। 

রাজা তাঁকে এই 'তুচ্ছ' প্রাইজ চাওয়ার জন্য যারপরনাই তাচ্ছিল্য করলেন।

কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন, 'এখনই একে গম দিয়ে বিদেয় কর।'

কিন্তু গমের হিসাব করতেই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। ফলাফল যা বেরুলো, সেই পরিমাণ গম রাজার চৌদ্দপুরুষেও দেওয়া সম্ভব নয়। তাই গল্পের কোনো এক সংস্করণের মতে রাজা পরে তাঁকে তার মন্ত্রী বানিয়ে নেন।

চলুন তাহলে দেখে ফেলি ঐ উদ্ভাবক কত গম পেতেন, যা দেওয়া রাজার জন্য অসম্ভব হয়ে গেলো।

প্রথম ঘরের জন্য ১ টি, ২য় ঘরের জন্য ২ টি...... এভাবে প্রতি ঘরে আগের ঘরের দ্বিগুণ হতে থাকলে মোট গমের সংখ্যাকে আমরা নিচের ধারায় প্রকাশ করতে পারি-

1 + 2 + 4 + 8+...  
(৬৩ বার দ্বিগুণ করে যোগ করা হবে। কেননা শুরু হয়েছে ১ থেকে।)

= 20 + 21 + 22  + 23+...+  263 । 
এর মান আমরা কয়েকভাবে বের করতে পারি।
যেমন, ধরি
S = 20 + 21 + 22  + 23+...+  263

উভয়পক্ষকে 2 দ্বারা গুণ করে,
2S = 21 + 22 + 23  + ... + 264

বিয়োগ করে,

2S - S = -20 + 264
∴ S = 264 - 1

অথবা ধারার মাধ্যমে বের করতে পারি।
উপরের ধারাটি একটি গুণত্তর ধারা যা এ রকম,
a + ar + ar2 + ... + ar(n-1) 
যেখানে প্রতিটি পদ হল ark ; আর k এর মান হল ০ থেকে (n-1) পর্যন্ত।
আমরা জানি, এমন ধারার সমষ্টি
$$\sum_{k=0}^{n-1}(ar^k) = a (\frac{1-r^n}{1-r})$$
তাহলে, আমাদের এখানে প্রথম পদ, a = 1।
সাধারণ অনুপাত (যেহেতু গুণোত্তর ধারা), r = 2 (যেমন $\frac{2^2}{2^1}=\frac{4}{2}=2$)
এবং n = 64
অতএব, সমষ্টি
$$\sum_{k=0}^{64-1}(ar^k) = 1 (\frac{1-2^{64}}{1-2})$$

$$= (\frac{1-2^{64}}{-1}) = 2^{64} -1$$
= 18,44 6,744,073,7 09,551,615 

অর্থাৎ, রাজাকে এতগুলো গম প্রদান করতে হবে। অনেকের কাছে হয়তো এখনও মনে হচ্ছে এ আর এমন কি! এটা ১৮৪৪ কোটি কোটি (আবার বলছি কোটি কোটি) টি গমের চেয়েও বেশি। 

আসুন গম গুলোকে বস্তায় ভরি!
দেখি কত বস্তা গম হয়। 

তাহলে, আগে বের করতে হবে প্রতি বস্তায় কত গম ধরবে। আর সেজন্য জানা দরকার গম ও বস্তার আকার। স্বাভাবিক আকারের বস্তার ব্যাস হয় প্রায় ২ ফুট (61 সে.মি., তাহলে, ব্যাসার্ধ, r= ৩০.৫ সে.মি.) , উচ্চতা (h) আড়াই ফুট (76 cm)।

অতএব, প্রতি বস্তার আয়তন $$V =\pi r^2h$$
(যেহেতু বস্তা সিলিণ্ডার আকৃতির।) 
মান  বসিয়ে, $$V = 3.1416 × 30.5^2 × 76 cm^3$$
 $= 2, 22, 107 cm^3$ (প্রায়)

এবার গমের আয়তন বের করি। 


আমরা জানি গমের আকার হয় দৈর্ঘ্যে যথাক্রমে প্রায় ৫ ও ৯ মিলি মিটার। গমকে যদি আমরা উপবৃত্ত বিবেচনা করি তাহলে যেহেতু উপবৃত্তের আয়তন হচ্ছে $\frac{4}{3}\pi abc$, 
যেখানে a, b,c হচ্ছে মূল বিন্দু বা কেন্দ্র থেকে অক্ষত্রয়ের প্রান্তিক সীমা। 

গমের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, বৃহত্তর অক্ষ , a = 9/2 = 4.5 mm = .45 cm। 
গমের আকৃতির জন্য অন্য দুইটি অক্ষ সমান, ফলে b = c = 5/2 = 2.5 mm = .25 cm।

তাহলে প্রতিটি গমের আয়তন $$\frac{4}{3}×0.45 × 0.25 × .25 cm^3 = 37.5 cm^3 = .0375 cm^3$$
অতএব, বস্তার আয়তনকে গমের আয়তন দিয়ে ভাগ করে আমরা পাই, 
প্রতি বস্তায় গমের সংখ্যা 59, 22, 879 টি (প্রায়)। 

তাহলে মোট গমের সংখ্যাকে এটা দিয়ে ভাগ করে আমরা পাই, 3, 11, 44, 89, 435, 579 বস্তা। 

অর্থাৎ মোত এতটি বস্তা লাগবে। 
এর মানে ৩১ লাখ ১৪ হাজার ৪৮ কোটি ৯৪ লাখ ৩৫ হাজার পাঁচশ ৭৯ বস্তা গম লাগবে। এবার ভাবুন! কি পরিমাণ শুধু বস্তাই লাগবে!! 

১ লাখ বস্তা গমই তো কত! অথচ এখানে ৩১ লাখ ১৪ হাজার কোটিরও বেশি! 

বাস্তবে অবশ্য বস্তার সংখ্যা আরো বেশি হবে, কারণ এখানের হিসাবে বস্তায় গম ১০০% ঠেঁসে ভরা হয়েছে, ফলে বস্তায় একটুও ফাঁকা যায়গা নেই। কিন্তু বাস্তবে বস্তায় কিছু জায়গা ফাঁকা থাকবে। 

এ পরিমান গমের ওজোন কত?
আমরা জানি, গমের ওজোন (সঠিক করে বললে ভর) হয় ৩৫ থেকে ৫০ মিলি গ্রাম। না হয় আমরা গড়ই নিলাম, ৪২ মিলি গ্রাম = ০.০৪২ গ্রাম = ০.০০০০৪২ কেজি। 

তাহলে মোট ভর (প্রচলিত ভাষায় ওজন) = 18,446,744,073,709,551,615 × .000042 kg।

অর্থাৎ 774763251095801 কেজি (প্রায়) = 774763251095 মেট্রিক টন।

বা প্রায় ৭ হাজার সাড়ে ৭ শ কোটি মেট্রিক টন।

এবার মনে হয় আমরা বুঝতে পারছি, কেন রাজা এ পুরষ্কার দিতে অপারগ হলেন।

বিশ্বে গম উৎপাদনের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা দেখি ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ১৩৪ মেট্রিক টন গম উৎপাদিত হয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। একক দেশ হিসেবে চীন সর্বোচ্চ ১২৫ মেট্রিক টন উৎপাদনে সক্ষম হয়। সারা বিশ্বে ঐ বছর মোট ৬৭৫ মেট্রিক টন গম উৎপাদিত হয়।
উইকিপিডিয়ার ভাষ্য মতে, ওই পর্যন্ত ১৭ বছরে সারা বিশ্বে মোট ৯, ৮৭৯ টন গম হয়। 

এই গম উৎপাদন করতে কত বছর লাগবেঃ
রাজাকে যদি সুযোগ দেওয়া হত যে সারা বিশ্বে প্রতি বছর যে গম উৎপাদন হবে তা আপনাকে দিয়ে দেওয়া হবে, তবে পুরষ্কার দিতে রাজার কত সময় লাগবে?

গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৬৮০ টন গম ফলে। তাহলে ৭ হাজার সাড়ে ৭ শ কোটি টন গম ফলাতে কত বছর লাগবে? উত্তর হচ্ছে 113,93,57,722 বছর বা ১১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭২২ কোটি বছর। বাহ! দারুণ ব্যাপার! 

পৃথিবীর বয়স সাড়ে ৪ শ কোটি বছর। ঐ গম ফলাতে তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় লাগবে! (তাও এখন প্রযুক্তির কল্যাণে বেশি ফলন হচ্ছে, আদি কাল থেকে ফলাতে হলেই সেরেছে! কিয়ামত হয়ে গেলেও শেষ হত না, নিশ্চিত করেই বলা যায়)। আর মানুষও তো পৃথিবীর শুরু থেকেই ছিল না। 
পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে ২ লক্ষ বছর আগে।

তার চেয়ে দুই বন্ধুর কৌতুকের মতে বলে দেওয়া বড়ই সুবিধাজনক, 
বন্ধু, তোমার এই ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারবো না 😛

সূত্রঃ
১। http://arimaa.com/arimaa/links/chessStory.html
২। http://en.wikipedia.org/wiki/Wheat_and_chessboard_problem
৩। http://www.bakeinfo.co.nz/Facts/Wheat-Milling/Wheat/Wheat-grain
৪। http://www.infoplease.com/ipa/A0001659.html
৫। http://en.wikipedia.org/wiki/International_wheat_production_statistics
Category: articles

Wednesday, September 13, 2017

লিখেছেনঃ ড. রহমতুল্লাহ ইমন
(লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

এলাকাভেদে একটি মূল ভাষার আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্নতা আসতেই পারে। কিন্তু একটি শাস্ত্রের ভাষা কি অঞ্চল ভেদে ভিন্ন হতে পারে? এমন বিরল ঘটনা ঘটেছে পরিসংখ্যানের ভাগ্যে। আপনি যদি অন্যতম প্রধান বাংলাভাষী অঞ্চল ভারতের পশ্চিম বাংলার কোন শিক্ষিত মানুষকে পরিসংখ্যান শব্দটি বলেন তবে নিশ্চিতভাবেই তিনি অবাক বিস্ময়ে আপনার মুখের দিকে চেয়ে রবেন। কেননা শব্দটি তাঁর কাছে খুব একট পরিচিত নয়। খুব অবাক হচ্ছেন তাই তো? কেমন শিক্ষিত লোক যে পরিসংখ্যান শব্দটি শুনেই হোঁচট খাচ্ছে? আচ্ছা, এবার যদি আমি আপনার কাছে রাশিবিজ্ঞান সম্বন্ধে জানতে চাই? আমি নিশ্চিত আপনাদের অনেকেই এবার একে অপরের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। অনেকেই হয়তো শব্দটি জীবনে প্রথমবারের মত শুনলেন। আর যারা আগে শুনেছেন তারাও খুব স্বস্তি বোধ করছেন না। অথচ শব্দটি পশ্চিম বাংলার কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, সবাই বুঝে যাবেন যে এটা Statistics এর পরিভাষা। আমাদের দুই বাংলায় কেন দুটি ভিন্ন পরিভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে এটা বুঝতে হলে বাংলায় পরিসংখ্যান চর্চার ইতিহাসটিও জেনে নিতে হবে।

অবিভক্ত ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানের পঠন পাঠন প্রথম শুরু হয় কলকাতায়। ঢাকার বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিসকে বলা হয় ভারতের পরিসংখ্যানের জনক। পদার্থবিদ্যার ছাত্র মহলানবিস ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা নেবার সময় পরিসংখ্যানের জনক বলে খ্যাত স্যার রোনাল্ড ফিশারের সংস্পর্শে আসেন এবং বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি এই বিষয়টি আয়ত্ত করার জন্য আবারও ইংল্যান্ড যান। দেশে ফিরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করলেও তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল পরিসংখ্যান। ১৯৩১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পরিসংখ্যান পঠন পাঠন ও গবেষণায় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান Indian Statistical Institute। মহলানবিস Statistics এর বাংলা করেন রাশিবিজ্ঞান এবং এভাবেই নতুন প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় ভারতীয় রাশিবিজ্ঞান সংস্থা।

এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ১৯৩৮ সালে রাশিবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা করেন বাংলাদেশে পরিসংখ্যানের জনক বলে খ্যাত কাজী মোতাহার হোসেন। হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ছাত্র ছিলেন। এখানে পড়ার সময় তিনি বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ সত্যেন বোসের সংস্পর্শে আসেন। বোস হোসেনকে পরিসংখ্যান পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় হোসেন কলকাতায় এসে মহলানবিসের কাছে অধ্যয়ন করেন। ডিপ্লোমা শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে পরিসংখ্যান পঠন পাঠনে নতুন একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি রাশিবিজ্ঞান শব্দটির পরিবর্তে Statistics এর নতুন বাংলা নামকরণ করেন পরিসংখ্যান। পরবর্তীতে তিনি পরীক্ষণ নকশা (Design of Experiments) এর ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন, যার পরীক্ষক ছিলেন স্যার রোনাল্ড ফিশার। স্যার ফিশার হোসেনের শৃঙ্খলবদ্ধ নিয়ম (Hussin’s Chain Rule) এই কাজটি দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে তাঁর প্রশংসা করেছেন এবং মন্তব্য করেছিলেন যে,
হোসেন এমন কিছু কাজ করেছেন যা আমি নিজেও করতে পারতাম না।

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিস ও কাজী মোতাহার হোসেন শুধু নামকরা পরিসংখ্যানবিদই ছিলেন না, তাঁরা দুজনেই ছিলেন বাংলা ভাষায় সুপণ্ডিত। মহলানবিস ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সরাসরি ছাত্র এবং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার বন্ধু। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও হয়তো এগিয়ে ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। নজরুল মোতাহারকে আদর করে বলতেন ‘মোতি হার’। সাহিত্যে হোসেনের দক্ষতা দেখে নজরুল মন্তব্য করেছিলেন যে,
 মোতিহার যদি বিজ্ঞান চর্চা না করে সাহিত্যচর্চা করতেন তাহলে কবি সাহিত্যিকদের ভাত মারা যেত। 

কাজী মোতাহার হোসেন কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে মিলে ১৯২৬ সালে "মুসলিম সাহিত্য সমাজ" গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি কিছুকাল শিখা নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর অনেক বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে সঞ্চয়ন, নজরুল কাব্য পরিচিতি, সেই পথ লক্ষ্য করে, প্লেটোর সিম্পোজিয়াম, গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস, পরিসংখ্যান শব্দকোষ, আলোক বিজ্ঞান, নির্বাচিত প্রবন্ধ অন্যতম।

বহু প্রতিভার অধিকারী কাজী মোতাহার হোসেন 

বাংলা ভাষার ওপর তাঁর এতটাই দখল ছিল যে তাঁকে বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার কমিটির সদস্য করা হয়েছিল। অসাম্প্রদায়িক ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী এবং সেই আলোকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুদৃঢ় ভিত গড়ে তোলার জন্য তিনি লেখনী পরিচালনা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবীতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার একজন দৃঢ় পৃষ্ঠপোষক। বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রবন্ধাদি প্রকাশ করে এ সব আন্দোলনে গতিদান করেন। ১৯৬১ সালে প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার মুখে ঢাকায় রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতি খর্ব করার জন্য রেডিও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দাবা খেলোয়াড়। বাংলাদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ হিসেবে তাকে সম্মানিত করা হয়। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ১৯২৯ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত পাকিস্তানে একক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। দাবা খেলায় তার অনন্য অবদানের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের উদ্যোগে কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতি আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিস Statistics এর বাংলা করেন রাশিবিজ্ঞান। কাজী মোতাহার হোসেন এই অনুবাদটি গ্রহণ করেননি। না, এখানে ব্যক্তিগত বিরোধের কোন অবকাশ ছিল না, বরং তাঁদের পারস্পরিক আন্তরিকতার কথাই ছিল সর্বজনবিদিত। হোসেন ভাবতেন রাশিবিজ্ঞান শব্দটি দিয়ে Statistics কে পরিপূর্ণ ভাবে বোঝানো সম্ভব হয় না। রাশিবিজ্ঞান শব্দটির আক্ষরিক ইংরেজি করলে তা হয় Data Science। Data Science হাল আমলে Statistics এর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু তার ব্যাপ্তি Statistics এর মতো ব্যাপক নয়। আর সেকারণেই হোসেন একটি নতুন বাংলা শব্দের উদ্ভব করেন। পরি+সংখ্যা+অনট(অন) = পরিসংখ্যান অর্থাৎ সংখ্যা সম্পর্কিত বিজ্ঞান।

পরিসংখ্যান শুধুমাত্র সংখ্যা নিয়ে কাজ করে না, কিন্তু যখন বলা হয় সংখ্যা সম্পর্কিত বিজ্ঞান তখন তার ব্যাপ্তি Statistics কে ধারণ করে। যা হোক, আমাদের দুই বাংলায় Statistics এর পরিভাষা হিসেবে রাশিবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান শব্দ দুটির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেলেও আন্তর্জাতিক মহলে পরিসংখ্যান শব্দটিই স্বীকৃতি লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান সংস্থা (International Statistical Institute) ২০১০ সালে বিভিন্ন ভাষায় Statistics শব্দটির যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে Statistics এর পরিভাষা হিসেবে পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের পশ্চিম বাংলার অনেক বন্ধুকেই আজকাল দেখছি পরিসংখ্যান শব্দটি ব্যবহার করতে। না, শুধুমাত্র বিতর্ক সৃষ্টির জন্য নয়, অর্থের বিচারেই একদিন Statistics এর পরিভাষা হিসেবে পরিসংখ্যান ফিরবে সবার মুখে মুখে।

লেখকঃ অধ্যাপক, ম্যাথেম্যাটিক্যাল সায়েন্সেস,  Ball State University। 
Category: articles

Sunday, September 10, 2017

[লেখাটি ইতোপূর্বে বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের অক্টোবর, ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল]

আচ্ছা অনুমান করুন দেখি, বাংলাদেশে কত লোক ঘুষ খায়? আন্দাজে বলা কঠিন, তাই না?  কিন্তু ধরুন, আমরা জানতে চাই কোনো এলাকায় বা সরকারের কোনো বিভাগে প্রায় কত লোক ঘুষ খায় । আমরা যদি মানুষকে গিয়ে এভাবে জিজ্ঞেস করি, 'আপনি ঘুষ খান কি না?', তাহলেতো আর সব সময় সঠিক উত্তর পাব না। কিন্তু পরিসংখ্যান আর সম্ভাবনা তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই মোটামুটি একটা হিসাব করে ফেলা যায়।

এ কৌশলের মাধ্যমে আমরা কত লোকের মধ্যে প্রায় কত লোক ঘুষ খায় তা জানতে পারব। অবশ্য ঠিক কারা কারা ঘুষ খায় তা জানতে পারব না।



আমরা কাজটি করব পরিসংখ্যানের সম্ভ্যাবনার ধারণা কাজে লাগিয়ে। প্রথমেই আমাদেরকে পরীক্ষা চালানোর জন্যে কিছু লোক বাছাই করতে হবে। এই সংখ্যা যত বেশি হবে ততই ভালো, অন্তত এক হাজার নিলেও মোটামুটি চলবে। এদেরকে আমরা বলব টার্গেট গ্রুপ। এখন সাথে রাখতে হবে একটি ভালো (Fair) কয়েন। কয়েনটিকে হতে হবে নিখুঁত, অর্থ্যাৎ একে এমন হতে হবে যেন টস করলে হেড ও টেইল ওঠার সম্ভাবনা সমান থাকে। এই কয়েন নিয়ে আমরা এক এক করে আমাদের টার্গেট গ্রুপের ব্যক্তিদের কাছে যেতে থাকব।

ধরুন, আমরা মিস্টার এক্স এর কাছে গেলাম। তার কাছে প্রশ্ন থাকবে তিনি ঘুষ খান কি না। কিন্তু তাকে বিব্রত করা যাবে না। তা কী করে সম্ভব? সেটাই বলছি।

তাকে কয়েনটি দিয়ে বলতে হবে,
আপনি কয়েনটি টস করবেন। টসের ফলাফল আমাদেরকে জানানো লাগবে না। যদি টসে হেড পড়ে, তাহলে প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলবেন। আর যদি টেইল দেখেন তবে সত্য কথা বলবেন।

এখানেই হল মূল ব্যাপার। মনে রাখতে হবে যে উত্তর হ্যাঁ হতে পারে দুটো কারণে। এক, তিনি টস করে হেড পেয়েছেন অথবা দুই, তিনি টস করে টেইল পেয়েছেন এবং সত্যি সত্যিই ঘুষ খান। অতএব তিনি কি টসে হেড পড়াতে হ্যাঁ বলেছেন নাকি (টসে টেইল পেয়ে এবং) আসলেই ঘুষ খান বলে হ্যাঁ বলেছেন সেটা আমরা জানব না। ফলে তিনি নিরাপদ, তার সম্মান হানি হচ্ছে না। এই কথাটি ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলতে হবে, নাহলে সৃষ্টি হবে বিব্রতকর পরিস্থিতির।

এই পরীক্ষা চালিয়ে আমরা অনেকগুলো হ্যাঁ ও না পেলাম। মনে করি, আমরা এক হাজার লোকের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে মোট ৮০০ উত্তর পেলাম হ্যাঁ। অর্থ্যাৎ ঘুষ খায় কি না এই প্রশ্নের উত্তরে ৮০০ জন হ্যাঁ বলেছে। মনে রাখতে হবে এর মানে কিন্তু এটা নয় যে ৮০০ লোক ঘুষ খায়। এই ৮০০ লোকের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা সত্যি সত্যি ঘুষ খায় বলে হ্যাঁ বলেছে, আর কিছু লোক হ্যাঁ বলেছে কয়েনে হেড পড়তে দেখে।

তাহলে আমরা কীভাবে জানব কত লোক আসলেই ঘুষ খায়?

মনে করে দেখুন, আমরা পরীক্ষা চালিয়েছিলাম নিখুঁত কয়েন দিয়ে। এতে হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা ছিল সমান। এখন ১০০০ লোক নিয়ে পরীক্ষা চালানোর অর্থ হল ১০০০ বার কয়েন টস হবে। হেড ও টেইল পড়ার সম্ভাবনা সমান থাকার কারণে আমরা ধরে নিতে পারি যে এক হাজার টসের মধ্যে প্রায় ৫০০ টি হেড পড়েছিল। ফলে ৮০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৫০০ লোক এমন থাকবে যারা হ্যাঁ বলেছে টসে হেড পড়ার কারণে। এরা আসলে ঘুষ খায় কি না তা আমরা জানব না। কিন্তু বাকি ৩০০ টি হ্যাঁ বলা লোক হ্যাঁ বলেছে এ জন্যেই যে তারা আসলেই ঘুষ খায়। কারণ আমরা বলেছি টেইল পড়লে যাতে উনি সত্য কথা বলেন।

কয়েন নিখুঁত হবার কারণে টেইলও পড়বে প্রায় ৫০০ বার। এখন টেইল পড়ার পরও হ্যাঁ বলার অর্থ হল, এরা আসলেই ঘুষ খায়। তার মানে আমরা পেলাম, প্রতি ৫০০ লোকের মধ্যে প্রায় ৩০০ লোক ঘুষ খায়।
মজার ব্যাপার, তাই না?

কিছু বিষয় মাখায় রাখতে হবে:
১. টার্গেট গ্রুপকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে উনি ঘুষ খান কি না তা আমরা জানব না। উনি নিশ্চিন্তে উত্তর দিতে পারেন।
২. কয়েন নিখুঁত হলেও ঠিক অর্ধেক পরিমাণে হেড ও টেইল পড়বে না, দুটোর পরিমাণই হবে অর্ধেকের কাছাকাছি। ফলে আমরা যত বেশি মানুষ নিয়ে টেস্ট করব, ভুলের পরিমাণ তত কমবে।
৩. এই কৌশল খাটিয়ে একই রকম অন্য পরীক্ষাও চালাতে সম্ভব। যেমন কেউ ধূমপান করেন কি না বা অ্যালকোহল সেবন করেন কি না, বা আয়কর ফাঁকি দেন কি না ইত্যাদি।
৪. এখানে আমাদেরকে আরও ধরে নিতে হচ্ছে, মানুষ সত্য কথা বলবে। বাস্তবে যারা ঘুষ খাওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করতে পারে, তারা মিথ্যাও বলতে পারে। তবে যেহেতু ঘুষ খাওয়ার তথ্য ফাঁস হচ্ছে না, তাই আশা করা যায়, আমরা সত্যিটাই শুনব।

তথ্যসূত্রঃ 
এই পদ্ধতির উদ্ভাবক হলেন পরিসংখ্যানবিদ শেলডন রস। 

কৃতজ্ঞতায়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক স্যার ড. জাফর আহমেদ খান (বিষয়টি সহজ করে উপস্থাপন করার জন্যে স্যারকে ধন্যবাদ) 
Category: articles

Saturday, September 9, 2017

[লেখাটি ইতোপূর্বে পাই জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল] 

পরিসংখ্যানের বিভিন্ন ধাঁধা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে অনেক সময় মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে। মন্টি হল প্যারাডক্স নিয়ে চিন্তা করতে গেলেই চক্করটা একটু বেশি-ই হয়ে যায়। শত শত পিএইচডি ধারী পরিসংখ্যানবিদও এর বক্তব্য শুরুতে মেনে নিতে চান না।

সমস্যাটি কী, দেখা যাক।

মনে করুন, আপনি একটি গেম শোতে আছেন। আপনার সামনে আছে তিনটি দরজা। একটি দরজার পেছনে আছে একটি গাড়ি, অপর দুই দরজার পেছনে আছে দুটি ছাগল। আপনি একটি দরজা বাছাই করলেন। ধরুন সেটি ১ নং  দরজা। এখনও কিন্তু খুলেননি। খোলার আগে হোস্ট আপনাকে আরেকটা দরজা খুলে দেখাল। ধরুন সেটা ৩ নং। সে আগে থেকেই জানত, কোন দরজার পেছনে কী আছে। ৩ নং দরজা খুলে দেখা গেল, এতে ছাগল আছে। এখন সে প্রস্তাব দিল, 'আপনি কি ১ এর বদলে ২ নং দরজা বাছাই করতে চান?' এখন সিদ্ধান্ত পাল্টালে কি আপনার লাভ হবার সম্ভবানা আছে?


অর্থ্যাৎ ১ এর বদলে ২ নং দরজা বেছে নিলে গাড়ি পাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে কিনা?

Parade ম্যাগাজিনের আস্ক মেরিলিন পাতায় কলামিস্ট মেরিলিনকে এক পাঠক প্রশ্নটি করেন। মেরিলনের উত্তর ছিল গাড়ি পাবার সম্ভাবনা বাড়াতে হলে অবশ্যই অপশন বদল করা উচিত। কারণ, অপশন বদল করলে গাড়ি জেতার সম্ভাবনা হবে $\frac{২}{৩}$, আর না করলে $\frac{১}{৩}$।
কিন্তু কথটা ঐ কলামের অধিকাংশ পাঠক মেনে নিতে পারলেন না। কেন অপশন বদল করলে লাভ হবে? সমস্যাটি প্যারেড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবার পর প্রায় ১০,০০০ লোক এর বিপক্ষে মত দিলেন। এদের প্রায় ১০০০ জন আবার ছিলেন পিএইচডিধারী!

আসলে প্যারাডক্সটি স্বাভাবিক বুদ্ধির একেবারেই বিপরীত। ভাবলে মনে হয়, যে কোন একটা দরজা নিলেই হল। একটি দরজার পেছনে ছাগল দেখার পরে বাকি দুটো দরজার যে-কোনোটির পেছনে গাড়ি থাকতে পারে। তার মানে যে কোনোটির পেছনে গাড়ি থাকার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি, মানে $\frac{১}{২}$ করে।

গেম শো-টির আনুষ্ঠানিক শর্তগুলো এ রকমঃ
১. হোস্টকে অবশ্যই এমন কোন দরজা খুলবে, যা প্রতিযোগী বাছাই করেনি।
২. হোস্ট এমন দরজা খুলবে যার পেছনে ছাগল থাকবে, গাড়ি নয়।
৩. হোস্টকে অবশ্যই অপশন বদল করার অফার দিতে হবে।

কিন্তু পরিবর্তনে কীভাবে লাভ হয় আসলে?

সরল সমাধানঃ

প্রতিযোগীর উদ্দেশ্য হল গাড়ি জেতা। এখন জিনিস আছে মোট তিনটি- দুইটি ছাগল ও একটি গাড়ি। তাহলে দৈব চয়নে একটি দরজা খুললে গাড়ি জেতার সম্ভাবনা $\frac{১}{৩}$ এবং ছাগল জেতার সম্ভাবনা $\frac{২}{৩}$। অর্থাৎ অনুমানের উপর ভিত্তি করে একটি দরজা খুললে ছাগল জেতার সম্ভাবনা বেশি। এখন তাকে একটি দরজা খুলে দেখানো হল তাতে একটি ছাগল আছে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগের দরজাই খুলবে নাকি সিদ্ধান্ত বদলে অন্য দরজা খুলবে।

এবার মনে করুন, প্রতিযোগী প্রথমে ছাগল বেছেছিল। তাহলে বদল করলেই সে গাড়ি পেয়ে যাচ্ছে, কারণ খোলা দরজায় ছাগল দেখা যাচ্ছে।

অপরদিকে সে যদি প্রথমেই গাড়ি বাছাই করে থাকতো তবে বদল করলে সে পেত ছাগল। তার মানে, প্রথমে ছাগল বাছাই করলে লাভ হয় বেশি। সেক্ষেত্রে বদল করলেই গাড়ি! এখন ছাগল যেহেতু দুইটি, তাই প্রথমে ছাগল বাছাই হবার সম্ভাবনা বেশি। তার মানে বদল করলেই গাড়ি পাবার সম্ভাবনা বেশি! আশা করি স্পষ্ট হয়েছে।

মেরিলনের সমাধানঃ
প্যারেড ম্যাগাজিনে মেরিলিন ভস স্যাভান্ট একটি সারণির মাধ্যমে চিত্রটি তুলে ধরে খুবই সহজ ভাষায় সমাধান দিয়েছিলেন। একটি গাড়ি ও দুইটি ছাগল তিনটি দরজার পেছনে তিনভাবে বিন্যস্ত থাকতে পারে। মনে করুন, প্রতিযোগী প্রথমে ১ নং বাছাই করলনে। এবার দেখি, অপশন পাল্টালে আর না পাল্টালে কেমন রেজাল্ট হয়।


দেখা যাচ্ছে, আমাদের চূড়ান্ত অপশন ৩ টি। এর মধ্যে অপশন পাল্টালে গাড়ি, আর না পাল্টালে ছাগল পাবার সম্ভাবনা বেশি-যথাক্রমে ২ টি করে।
আরেকটি সহজ সমাধান দেখি ডায়াগ্রামের মাধ্যমে।


মন্টি হল সমস্যার সমাধান 

আমেরিকান টেলিভিশন অনুষ্ঠান লেটস মেইক আ ডিল নির্ভর এই প্যারাডক্সটির নাম দেওয়া হয় ঐ অনুষ্ঠানের প্রথম হোস্ট মন্টি হলের নামে। জীব-পরিসংখ্যানবিদ স্টিভ সেলভিন প্রথম আমেরিকান জার্নাল দ্য আমেরিকান স্ট্যাটিসটিক্সে সমস্যাটি পাঠান।

সূত্রঃ
[১] mathworld.wolfram.com/MontyHallProblem.html
[২]  en.wikipedia.org/wiki/Monty_Hall_problem
Category: articles